| | বঙ্গাব্দ

হোসেন আলী মুন্সী

হোসেন আলী মুন্সী

 হোসেন আলী মুন্সী।

নিশ্চয়ই অনেকে একটু হোঁচট খেলেন। কারণ তার এ নামটি অনেকের কাছে অজানা। তিনি কেবলাজান হুজুরের মুরিদ ও আশেক সমাজে হছু ভাই নামে পরিচিত।
পাগলাটে ধরণের চালচলন, পোশাক আশাক, কথা বার্তা,।
তার কথা বললেই জাকেরদের চোখের সামনে যে চেহারা টা ভেসে ওঠে তা এরকম।
হাতে বেশ কয়েকটা লাঠি, এলোমেলো পোশাক, আর মুখে এলোমেলো ভাষা।
তাকেও আমি চাচা ডাকতাম। কম বয়সেই তাকে আমি চিনি। দরবারে যেমন চিনি। আবার তিনি আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসতেন ও কিছুদিন থাকতেন সে কারণে একটু ভালো ভাবে চিনি।
সকল অলি আল্লাহদের দরবারে কিছু পাগল টাইপ এর লোক দেখা যায়। অনেক দরবারে আবার জটাধারী পাগল এর বেশ ধরা লোক ও দেখা যায়। যেহেতু বিশ্ব জাকের মঞ্জিল এ শরিয়ত বিরোধী কোন কর্মকান্ড করার সুযোগ নাই তাই এখানে পাগল চোখে পরে না।
হছু চাচা ছিলেন একমাত্র ব্যাতিক্রম। আসলে হছু চাচাকে পাগল বলাও মুশকিল। কারণ পাগলামি করাটা ছিল তার একটা খোলস। ঘরোয়া পরিবেশে তাকে যারা না দেখছে তাঁরা বুঝতেই পারবে না যে তিনি কতটা সুস্থ।
তার পাগল নামটা সম্ভবত কেবলাজানই জুড়ে দিয়াছেন। বিভিন্ন জায়গায় যাকেতাকে লাঠিপেটা করার কারণে কেবলাজানের কাছে নালিশ করা হলে কেবলাজান বলেন আমি তোমাদের মত লক্ষ লক্ষ পাগলের অত্যাচার সহ্য করি আর আমার একটা পাগলের অত্যাচার তোমরা সহ্য করতে পার না। নালিশ এর জবাব যেমন দিলেন একই সাথে সবাই কে জানিয়ে দিলেন হছু কেবলাজানের পাগল।
আসলেই তিনি কেবলাজানের এসকের পাগল ছিলেন। এমন সম্মোধনে কেবলাজান কে ডাকতেন যা আমি অন্তত আর কারো মুখে শুনি নাই। কেবলাজান কে তিনি ডাকতেন আব্বু বলে।
হছু চাচার একটি ঘটনা যা আমি কেবলাজানের একান্ত খাদেম মরহুম সিরাজ চাচার ( নাখাল পাড়া )কাছ থেকে শুনেছি।
একদিন কেবলাজানের জন্য একটা ওষুধ ডাক্তার ঢাকা থেকে আনানোর জন্য বললো। কিন্ত যখন বললো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও ভালো না। ওষুধ ও জরুরি দরকার। রাতে আর ব্যবস্থা করা গেলো না। সকালে ব্যবস্থা করা হবে। সকালে হুজুর কেবলাজান হুজরা শরীফে তসরিফ আনলেন। ডাক্তার সাহেব ও উপস্থিত। এমন সময় হছু দরবারে ঢুকেই হুজরা শরীফে গেলেন। একটা প্যাকেট কেবলাজান এর সামনে ধরলেন। কেবলাজান জানতে চাইলেন এতে কি। হছু বললো ওষুধ। কিসের ওষুধ। হছু শুধু বলে আব্বু ওষুধ। কেবলাজান ডাক্তার সাহেবকে বললেন বাবা দেখেন তো কি ওষুধ। ডাক্তার সাহেব প্যাকেট খুলে বললেন হুজুর আপনার জন্য যে ওষুধ দরকার সেই ওষুধ।
ডাক্তার সাহেব সন্ধ্যার পরে ওষুধ এর কথা বললেন সেটা কাউকে জানানো হয় নাই। সকালে জানান হবে। অথচ ঢাকা থেকে হছু ওষুধ কিনে সকালেই দরবারে পৌঁছে গেলেন।
আসলে আত্মার কাছে তো দূর কাছ নাই। আর যাদের কারবারই আত্মার জগৎ নিয়ে তাঁদের জন্য তো ঢাকা একটু বেশিই কাছে।
হছু চাচার মুখে একটি কথা আমার মনে খুব দাগ কেটে আছে তিনি প্রায়ই বলতেন দেশ স্বাধীন হয় নাই এই দেশ আবার স্বাধীন করতে হবে। যার অর্থ আজও আমার বোধ শক্তির বাইরে।
একদিনের একটা ঘটনা বলি সে দিন ঢাকা জাতীয় প্রেস ক্লাব এর সামনে লক্ষ লক্ষ জাকের উপস্থিত ছিল। সে দিনে জাকের সংগঠন এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়। হছু চাচা ও সেখানে আছেন। হাই কোর্ট মাজারের সামনে হছু চাচা লাল শালু পরা এক জটাধারী পাগল এর জটা ধরে আছেন। জটাধারী হাইকোর্ট মাজারের লোক। ঐ জায়গায় তাঁদেরই দাপট। ঐ পাগল বুজে নাই হছু কি জিনিস। অনেকেই হছু চাচাকে থামানোর চেষ্টা করছে। কে শোনে কার কথা। হছু চাচার রাগের কারন ঐ পাগল তিনাকে বলছে দেখিয়ে দেবে আর যায় কোথায়। হছু চাচা বারবার একই কথা বলছেন ঐ তোর ভিতরে কি আছে যে তুই আমাকে দেখাবি। তুই আমাকে কি দেখাবি দেখা, তুই তো নাপাক, তুই আমার কিছু করতে পারলে কর না হলে তোর জট আমি কেটে দিবো। জাকের ভাইদের বার
বার চুল কাটার কেচি আনতে বলছেন। সবাই তাকে থামানোর চেষ্টা করছে কাজ হচ্ছে না। শেষে কেবলাজানের আর একজন অতি কাছের মুরিদ যাকে হছু চাচা খুব মানতো ও সম্মান করতো মরহুম এলাহী বক্স ( লক্ষী বাজার ) চাচা এসে হছু চাচার হাত থেকে ঐ ভন্ডকে উদ্ধার করেন। হছু চাচার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ভন্ড পাগলের দৌড় আমার এখনো হাসির কারণ হচ্ছে।
বাইরে র মানুষ দের সামনে তিনি যেমন পাগলামি করতেন একান্ত পরিচিত লোকদের মাঝে বা যেখানে থাকতেন সেখানে তিনি একেবারে স্বাভাবিক মানুষ। আমাদের বাসায় থাকা অবস্থায় দেখেছি।
মাঝে মাঝে আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন লোক আমাকে কি কয়, আমিকি পাগল কোনো?
আমাদের বাসার কাছে এক পীর /পাগল ভক্ত মুরুব্বি থাকতেন। তার মূত্রথলিতে পাথর হয়েছে। প্রসাব এর সময় প্রচন্ড যন্ত্রনা হয়। মুরুব্বি আমাকে বলছে আপনাদের বাসায় যে পাগল আসছে তাকে আমার চিকিৎসাটা করতে বলেন। আমি বললাম সে ঐ ধরণের পাগল না। তার কাছে গেলে কপালে মাইর আছে।অনেক পীড়াপীড়ির পরে তাকে বাসায় নিয়ে গেলাম। তাকে দেখেই হছু চাচা বললেন সারা জীবন মেয়ে মানুষ নিয়ে শয়তানি করার ফল কেমন লাগে, এই বলেই হাতের কাছে থাকা লাঠি দিয়ে তার বিশেষ অঙ্গতে এক বারি। লোকটার লুঙ্গি পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে গেলো। কোন মতে তাকে তার বাসায় দিয়ে আসলাম। বাসায় আসার পরে চাচা আমাকে বললেন, "আমি পাগল কোন "।
ঐ মুরব্বি তার পর বেশ কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন। তার আর কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না।
সারাদেশে ঘুরে ঘুরে জাকের ভাইদের কাছ থেকে নিজের কথা বলে টাকা উঠাতেন কিন্তু একটা টাকাও নিজে ব্যায় করতেন না। তাকে কোন খাবার কিনে দিলে পছন্দ হলে খেতেন বা কাউকে দিয়ে দিতেন কিন্তু টাকা দিলে নিজে তো ব্যায় করতেনই না। তার টাকার ব্যাগ এর দিকে কেউ তাকালে ও তার কপালে মাইর ছিল।কত টাকা যে তিনি সংগ্রহ করতেন তা অনেকের চিন্তা শুধু না কল্পনার বাইরে। এসব টাকা তিনি বিভিন্ন বাসায় জমা রাখতেন। এরকম তিনার বেশ কয়েকটা ঘাঁটি ছিল। আমার আম্মা ও তার একজন ক্যাশিয়ার ছিল। শুধু ঢাকাতেই তার আরো অনেক ক্যাশিয়ার ছিল। দরবারে যাওয়ার সময়ে তিনি এসব টাকা এককরে,বিশেষ করে উরস শরীফ এর সময়ে এসব টাকা নিয়ে নিজে কেবলাজান এর হাত মুবারকে তুলে দিতেন।
টাকা তোলার তার কত যে কায়দা ছিল তার শেষ নাই।
আমি একদিন গুলিস্তান পুলিশ বক্স এর সামনে দিয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে বেশ কিছু বন্ধু। হঠাৎ পিছন দিয়ে কে একজন আমার কলার টেনে ধরলো। আমার সাথের সবাই তাকে ঠেকাতে গেলো আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি হছু চাচা। সবাই কে থামালাম। বললাম চাচা কিছু বলবেন। বললেন আমাকে চারটা কলা কিনে দে। আমি বললাম নেন। সামনেই ফলের দোকান। চাচা বললেন এই কলা না। আমাকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এর উত্তর গেটে হাউস বিল্ডিং এর নিচে নিয়ে গেলেন। ওখানে বেশ বড় বড় কলা দেখিয়ে বললেন এইগুলো নিবো। বললাম নেন। আমি দাম জানতে চাইলাম। কলাওয়ালা দাম বলার পরে হছু চাচা বললেন কলা লাগবে না ঐ টাকা আমারে দে। বললাম টাকা নিলে তো ঐখানেই নিতে পারতেন। বললেন ঐখানের কলা ছোট দাম কম এই কলাগুলো বড় দাম বেশি। তাই এখানে নিয়ে আসছি। এমন কত ভাবে যে তিনি টাকা আদায় করতেন জাকের ভাইদের কাছ থেকে তা আল্লাহ ভালো জানেন।
দরবার শরীফ এর ওলামাদের ভিতরে মাওলানা আনসারী ছাহেব , মাওলানা সালাউদ্দিন সাহেব ও মাওলানা ফজলুর রহমান দেওবন্ধী ছাহেব ছাড়া আর কাউকে তিনি খুব একটা হিসাবে ধরতেন না। একদিন আনসারী চাচা কে জিজ্ঞেস করছিলাম হছু চাচার বিষয়ে, শুধু বললেন হছু ভাই অন্য রকমের মানুষ।
আর একদিনের কথা মনে পড়ে আমাদের বাসায় চাচা। বেশ জ্বর শরীরে। ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার প্যারাসিটামল ১০ টা ফাইমোক্সসিল ১০টা আর একটা কি ওষুধ মনে নাই দিলেন। আমি সকালে একটা প্যারাসিটামল একটা ফাইমোক্সসিল চাচাকে খেতে দিলাম বললাম আপনি রেস্ট নেন আমি কলেজ থেকে এসে দুপুরের ওষুধ দিবো।দুপুরে বাসায় এসে দেখি সব ওষুধ এর পাতা খালি। চাচাকে বললাম ওষুধ কি করছেন। বললেন বারবার খেতে মনে থাকবে না তাই একসাথে খাইছি। কোনো সাধারণ মানুষ ঐসকল ওষুধ একসাথে খেলে কি হবে ভাবুন।
কেবলাজানের শরিয়ত এর শেষ উরস শরীফ এর আগে কেবলাজান ঢাকা থেকে দরবারে যাবেন আমরা কয়েকজন একটা খেদমতে সম্প্রীকত ছিলাম। সন্ধ্যায় দেখলাম হছু চাচা খুবই উত্তেজিত। রাগের সাথে এক খাদেমকে বলছেন তুই তো টাকার পাগল যা তোরে টাকা দিয়ে কিনলাম এই বলে একটা টাকার বস্তা তার গায়ে ছুড়ে মারলেন। আমরা কয়েকজন আরিচা উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলাম। এয়ার পোর্ট এর সামনের আইল্যান্ড উপর হছু চাচাকে দেখলাম মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এটাই হছু চাচাকে আমার শেষ দেখা। কেবলাজান দরবারে গেলেন উরস শরীফে ও হছু চাচা কে আর দেখা গেলো না। কেবলাজানের বেছাল হলো হছু নাই। তারপর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ।
মনে হয় কেবলাজানের বিরহ বেদনা তিনি সহ্য করতে পারবেন না তাই চরম কিছু দেখার আগেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
কি যে হয়েছে তার তা আল্লাহপাক আর তার বন্ধু কেবলাজানই ভালো জানেন।
তবে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল এ হছু চাচাকে খুব মিস করি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন