| | বঙ্গাব্দ

আবুল বারাকাত নূরুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে মোল্লা জামী রহ.


আবুল বারাকাত নূরুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে মোল্লা জামী রহ.


ফারসী ভাষায় লিখা একখানা কবিতা। কবিতার বিষয়বস্তু খুবই উচ্চাঙ্গের। রাসূল (সাঃ)- এর শানেই এই কবিতা রচিত। এর রচয়িতা ছিলেন একজন আশেকে রাসূল, নবী প্রেমিক রাসূল (সাঃ)- এর প্রতি অগাধ ভালবাসা, সীমাহীন প্রেম ও হৃদয়ের ভক্তির্পূণ ঐকান্তিক আবেগের টানেই তিনি রচনা করেছিলেন কবিতাখানা । এতে তিনি প্রিয় মাহবুব (সাঃ)- এর দৈহিক সৌর্ন্দয, বড়ত্ব, মহত্ব, উদারতা, বদান্যতা, নম্রতা, ভদ্রতা, প্রভৃতি সুমহান চারিত্রিক গুণগুলোকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গীমায় তুলে ধরেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)- এর পাহাড়ের মত অবিচল সাহস, আকাশের মত বিশাল বিস্তৃত হৃদয়, সমুদ্রের মত গতিশীল ও বিক্ষুদ্ধ চেতনা, পাথরের মত মজবুত ব্যক্তিসত্ত্বা ইত্যাদি অনুপম গুণ ও আদর্শের কোনটিই এতে বাদ দেননি তিনি। তার কবিতার প্রতিটি ছত্রেই ছিল প্রিয় নবী (সাঃ)- এর প্রতি গভীরতম ভালবাসার এক দৃষ্টান্তহীন নযীর। নিখাদ প্রেমের এক অপূর্ব উদাহরণ।
আল্লামা জামী (রাহঃ) এ কবিতার সার্থক রচয়িতা। তাঁর পুরো নাম আবুল বারাকাত নূরুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে মোল্লা জামী (রাহঃ)। সারা বিশ্বে তিনি মোল্লা জামী নামেই সর্বাধিক পরিচিত।
এই কবিতা খানা রচনা করার পর রাসূল প্রেমে আত্নহারা এ মহান বুযুর্গ বারবার এটি আবেগ জড়িত কণ্ঠে আবৃত্তি করে রাসূলের প্রতি গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন। তখন তাঁর চোখ হতে মুক্তা দানার ন্যায় অশ্রুধারা প্রবাহিত হত।
৮৭৭ হিজরীর ঘটনা।
একদা তিনি মক্কা উপস্হিত হয়ে হজ্বের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন শেষে ভাবলেন, মদীনা গিয়ে রওজা আতহারের সামনে দন্ডায়মান হয়ে এই কবিতাখানা পাঠ করবেন। হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা উজার করে তা আবৃত্তি করবেন। প্রেমের এক অনন্য নযীর স্হাপন করবেন এই কবিতার ভক্তিপূর্ণ আবৃত্তির মাধ্যমে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি পথ চলতে শুরু করলেন।
এদিকে মক্কার তৎকালীন শাসনকর্তা স্বপ্নযোগে দেখতে পেলেন স্বয়ং রাসূল (সাঃ) তাকে বলছেন, আব্দুর রহমান জামীকে মদীনায় আসতে দিও না। যে কোন উপায়ে তাকে মদীনায় প্রবেশ করতে বারণ কর।
পরদিন সকালে আল্লামা জামী (রাহঃ) কে খুঁজে বের করার জন্য মক্কার শাসন কর্তা লোক পাঠালেন। লোকদের বলে দিলেন তোমরা তাকে খুঁজে পেলে মদীনায় যেতে নিষেধ করবে। কিছুতেই মদীনায় ঢুকতে দিবে না। বলবে মক্কার শাসনকর্তা আপনাকে মদীনায় প্রবেশ করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন।
অনেক খোঁজা খোঁজির পর লোকজন আল্লামা জামীর সাথে সাক্ষাত করল। তারা তাকে মক্কার শাসনকর্তার নিষেধাজ্ঞার কথা জানাল। এ কথা শুনে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। ভাবলেন, তাহলে কি আমার আশা পূর্ণ হবে না! এতদিনের লালিত স্বপ্ন কি আজ ধুলোয় মিশে যাবে? আমি কি এমন অপরাধ করেছি যে, মক্কার শাসক আমাকে মদীনা যেতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন? বারণ করেছেন মদীনায় প্রবেশ করতে?
আল্লামা জামী (রাহঃ) লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা! আমার উপর কেন এই নিষেধাজ্ঞা? তা কি আপনারা জানেন?
তারা বলল, আমাদের কে এর কারণ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। শুধু নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য আমাদের কে পাঠানো হয়েছে।
আল্লামা জামী (রাহঃ) বললেন, ঠিক আছে। আপনারা এখন যেতে পারেন। আমি নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার চেস্টা করব। লোকজন চলে গেল।
রাসূল প্রেমিক এ বুযুর্গ অনেক চিন্তা ভাবনা করলেন। আলোচ্য নিষেধাজ্ঞার কারণ কি? তা বের করতে যথা সাধ্য চেস্টা চালালেন। কিন্তু কিছুই বের করতে সক্ষম হলেন না। তিনি এখন সীমাহীন অস্হিরতায় ভুগছেন। কোন কিছুই ভাল লাগছেনা তাঁর। মনে মনে চিন্তা করলেন, এটা কতবড় দুঃখজনক কথা যে, রাসূল (সাঃ)- এর দেশে এসে, তাঁর রওজা না দেখেই ফিরে চলে যাব? তাঁর প্রতি সালাম পেশ না করেই আপন নীড়ে প্রত্যাবর্তন করব। কেন আমাকে মক্কার শাসক বারণ করল! কি অন্যায় করেছি আমি! এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর পেরেশানীর মাত্রা ক্রমান্বয়ে আরো বৃদ্ধি পেতে লাগল।
তিনি নিষেধাজ্ঞার কারণে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে মনস্হ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পড়েই মনোভাব পাল্টে গেল। কারণ যার হৃদয়ের সমস্ত অংশ রাসূলের প্রেম-ভালবাসায় ভরপুর, যিনি রাসূলের মহব্বতে আপন জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তু ত, তিনি কেমন করে রাসূলের রওজায় না গিয়ে থাকতে পারেন। কিভাবে তিনি ভক্তিপূর্ণ সালাম পেশ না করে শান্তি পাবেন। না, তা কিছুতেই হতে পারে না। শত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হলেও তাকে মদীনায় যেতে হবে। এতে জেল-জুলুম যাই ভাগ্যে জুটুক না কেন, তা অম্নান বদনে সহ্য করতে হবে। অন্যথায় তার অশান্ত মন শান্ত হবে না।
এবার তিনি কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে অতি সংগোপনে একাকী মদীনার পথে রওয়ানা দিলেন। পাহাড়-পর্বত, মাঠ-ঘাট অতিক্রম করে অতি কস্টে সামনে এগিয়ে চললেন।
এদিকে মক্কার শাসনকর্তা আবারও স্বপ্নে দেখলেন, রাসূল (সাঃ) তাকে সম্বোধন করে বলছেন, জামী কিন্তু তোমার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে চলছে। তুমি তাকে কঠোর ভাবে বাঁধা দেও। এবার মক্কার শাসনকর্তা কালবিলম্ব না করে দু’জন লোক পাঠিয়ে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসেন এবং কয়েদখানায় আবদ্ধ করে রাখেন। সুতরাং এখন থেকে আল্লামা জামী (রাহঃ)- এর বন্দী জীবন শুরু হল।
তৃতীয়বার আমীরে মক্কা স্বপ্নযোগে দেখতে পেলেন, রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাকে বলছেন, হে মক্কার শাসক! একি করলে তুমি? তুমি জামীকে জেলখানায় আবদ্ধ করেছ! অথচ সে তো এমন কোন অপরাধ করেনি যে, তুমি তাকে কয়েদখানায় বন্দী রেখে কস্ট দিতে পার। আমি তো তোমাকে এমনটি করতে বলিনি। আমি বলেছিলাম, তাকে মদীনায় আসতে বারণ কর। আর তুমি কিনা তাকে বন্দী করলে! কয়েদখানায় আবদ্ধ করে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করলে?
মনোযোগ সহকারে কান পেতে শুন। আল্লামা জামী আমার আশেক। তার হৃদয় আমার প্রেম ভালবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ। আমাকে ছাড়া সে কিছুই বুঝে না। আমি ব্যতীত তার জীবন যেন অর্থহীন, অসম্পূর্ণ। শয়নে-স্বপনে সে কেবল আমাকে নিয়েই মগ্ন থাকে। আমিই যেন তার সবকিছু।
শুন, আমার প্রেমে আত্নহারা হয়ে সে একটি কবিতা রচনা করেছে। প্রতিদিন বড় আবেগের সাথে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে এ কবিতাখানা সে পাঠ করে। এবার মনস্হ করেছিল, আমার রওজার পাশে এসে কবিতাখানা আবৃত্তি করবে। সরাসরি আমাকে পাঠ করে শুনাবে। সে যদি এ সুযোগ পেয়ে যায় এবং বাস্তবিকই এ কবিতাখানা আমার কবরের পাশে এসে করুণ কণ্ঠে পরিবেশন করতে শুরু করে, তাহলে তার সাথে মুসাফাহা করার জন্য অবশ্যই আমাকে হাত বের করে দিতে হবে। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর বুকে ফিতনা ও বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে। এ ফিতনা থেকে জগতবাসী কে বাঁচানোর জন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম, তাকে মদীনায় আসতে বাঁধা দেও। আর তুমি কিনা আমার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তাকে বন্দীত্বের জীবন যাপন করতে বাধ্য করলে! এটা কতবড় আফসোস ও দুঃখজনক কথা!!
স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে মক্কার শাসকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি দ্রুত কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে জেলখানায় পৌঁছে আল্লামা জামী (রাহঃ) কে জেল থেকে মুক্ত করে বাইরে নিয়ে আসেন এবং এ অপ্রত্যাশিত ভুলের জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারপর তাকে স্বপ্নের পূর্ণ বিবরণ শুনিয়ে ইজ্জত ও সম্মানের সহিত বিদায় দেন।
ফার্সী ভাষায় রচিত এক কবিতাখানার কয়েকটি পংক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরুপ-
হে নবী! যার মুখের থুথুও তৃপ্তিদায়ক, আপনি জাগ্রত হোন, যেমন জাগ্রত হয় নার্গিস ফুল তার বিভোর নিদ্রা থেকে। ইয়ামেনী চাদর খুলে চেহারা মুবারক বের করে দিন।
কারণ আপনার মুখচ্ছবি হচ্ছে জীবন সকাল-নবজীবনের সূচনা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন