হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (রহঃ) ৮২ হিজরির ১৭ ই রবিউল আউয়াল মদিনায় জন্মগ্রহন করেন।
তিনি দয়াল নবী (সাঃ) 'র পবিত্র রক্তাধারা ছিলেন। রাসূল (সাঃ)'র প্রিয় সাহাবি হযরত আবু বকর ( রাঃ), তিনার পুত্র ছিলেন হযরত মুহাম্মদ বিন আবু বকর, তিনার পুত্র ছিলেন হযরত কাসেম বিন আবু বকর। হযরত কাসেম বিন আবু বকর (রহঃ) কন্যা ছিলেন হযরত ফারওয়াহ ফাতেমা (রহঃ)।
অন্যদিকে হযরত আলী (রাঃ), তিনার পুত্র হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ), তিনার পুত্র হযরত জয়নাল আবেদিন (রাঃ) তিনার পুত্র হযরত ইমাম বাকের (রাঃ)।
হযরত ইমাম বারেক (রাঃ) এবং হযরত ফারওয়াহ ফাতেমা র সহিত বিবাহ বন্ধে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনারদের পবিত্র কোলে জন্মগ্রহন করেন মহা মানব হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ)।
দুনিয়ার যত তরিকা আছে সব গুলো তরিকা ই দুটি ধারায় বহমান। একটি হযরত আবু বকর (রাঃ) হতে আরেকটা ধারা হযরত আলী (রাঃ) হতে। আর এই দুই ধারা এক সাথে মিলিত হয়েছে হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) মাধ্যমে। তিনি নক্সবন্দিয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকার যেমনি মাশায়েখ ঠিক তেমনি কাদেরিয়া-চিশতিয়া তরিকার ও মাশায়েখ।
তিনার বক্তব্যের সত্যতার কারনে তিনি "সাদিক" বা সত্যবাদি নামে খ্যাত হন।
তিনি রাসূল (সাঃ) এঁর আহলে বায়াতের ঘরেই বেড়ে উঠেন। ইমাম পরিবারের মধ্যে কারবালার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হযরত জয়নুল আবেদীন (রাঃ) কদম পাকে তিনি ১২ বছর সান্নিধ্য ও শিক্ষা পেয়েছিলেন।
দাদার ওফাতের পর তিনি তাঁর বাবা হযরত ইমাম বাকের রাঃ কাছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষন লাভ করেন। সেই সাথে তিঁনার নানাজান হযরত কাসেম বিন আবু বকর (রহঃ) নিকট থেকে খোদাতত্ত্ব জ্ঞান অর্জন করেন।
ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) মহ সাগরের মত অগাধ জ্ঞানের অধিকারি ছিলেন। তিনি যে জ্ঞানের অধিকারি ছিলেন তা ছিলো নবুয়াতের জ্ঞানের ই উত্তরাধিকার। আর এই জ্ঞান আল্লাহর অতি নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তির ছাড়া অন্যদের পক্ষে অর্জন করা ছিলো অকল্পনীয়।
তাই তিঁনি বলতেন, " আমার বক্তব্য আমার পিতা ইমাম বাকেরের বক্তব্য, আমার পিতার বক্তব্য আমার দাদা হযরত জয়নুল আবেদীন (রাঃ)'র বক্তব্য। আমার বক্তব্য হযরত আলী (রাঃ)'র বক্তব্য, হযরত আলী (রাঃ)'র বক্তব্য রাসূল (সাঃ)'রই বক্তব্য। আর রাসূল (সাঃ) বক্তব্য মহান খোদাতায়ালার ই বক্তব্য।"
তিনি আরো বলতেন, "আমাদের ( আহলে বায়াত) কাছে রয়েছে ভবিষ্যতের জ্ঞান, অতীতের জ্ঞান, অন্তরের অনুপ্রানিত জ্ঞান, ফেরেশতাদের বানী যা আমরা শুনতে পাই, আমাদের কাছে রয়েছে রাসূল (সাঃ)'র পবিত্র অস্ত্রসমূহ যা হযরত ইমাম মেহদী (আঃ) না আসা পর্যন্ত এগুলো আমরা হাত ছাড়া করবো না। আমাদের কাছে আছে হযরত মূসা (আঃ)'র তৌরাত, হযরত ঈসা (আঃ) ইঞ্জিল, হযরত দাউদ (আঃ)'র যাবুর এবং মহান খোদাতায়ালার পাঠানো অন্যান্য আসমানি কিতাব সমূহ। এছাড়াও আছে হযরত ফাতেমা (রাঃ)'র পবিত্র সহিফা যাতে রয়েছে সমস্ত ভবিষ্যৎ ঘটনার বর্ননা এবং পৃথিবীর শেষ ঘন্টা পযর্ন্ত সমস্ত শাসকগনের নাম। আমাদের কাছে আছে আল জামি নামের দলিল যাতে লিখা রয়েছে হযরত রাসূল (সাঃ)'র পবিত্র জবানিতে উচ্চারিত ও নির্দেশিত বানি এবং ঐসব বানি হযরত আলী (রাঃ) নিজ হাতে লিখেছেন। আল্লাহর শপথ! এতে রয়েছে মানুষের জন্যে কিয়ামত পযর্ন্ত প্রয়োজনীয় সব কিছু।"
তিনি ছিলেন একাধারে ফিকাহ, হাদিসবিদ, কোরআন মাজিদের তাফসির কারক, গনিতিবিদ ও রসায়নবিদ।
পৃথিবির বিখ্যাত ফিকহ মুহাম্মদ বিন মুসলিম, বিখ্যাত দার্শনিক হিশাম, গনিত ও রসায়ন শাস্ত্রের বিখ্যাত পন্ডিত জাবের ইবনে হাইয়ানের মত ব্যক্তিরা তিনার জ্ঞানের স্পর্শ পেয়ে ছিলো। হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহঃ), হযরত হাসান বসরি(রহঃ), ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)'র মত জ্ঞানিরা তিনার ছাত্র ছিলো।
হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠা হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেন, " আমি জাফর ইবনে মুহাম্মদ থেকে বড় কোনো জ্ঞানী বা ফিকহকে দেখনি। সবচেয়ে জ্ঞানি ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যে মানুষের মধ্যে মত পার্থক্যের বিষয় গুলো সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখেন। আর জাফর সাদেক হলেন সেই জ্ঞানের অধিকারি।"
মালিকি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, " এক সময় আমি জাফর ইবনে মুহাম্মদের কাছে যাওয়া আসা করতাম। যখনই যেতাম আমি তাঁকে তিন অবস্থায় পেতাম, হয় তিনি নামাজ পড়ছেন অথবা রোজা রেখেছেন অথবা কোরআন মাজিদ তিলাওয়াত করছেন। জ্ঞান, ইবাদত, তাকওয়াতর ক্ষেত্রে জাফর ইবনে মুহাম্মদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে আমি দেখিনি।"
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ)'র ঘর ছিলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত যেখানে বড় বড় মুনীষীরা তাঁর কাছে হাদিস, তাফসির, দর্শন ও কালাম শাস্ত্র শিখতেন। তাঁর ক্লাসে সাধারনত দুই হাজার প্রসিদ্ধ আলেম অংশ নিতেন। কখনও কখনও এ সংখ্যা চার হাজারে পৌছাত।
দয়াল নবী রাসূল (সাঃ) পবিত্র সিনা মোবারকের রক্ষিত জ্ঞান হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) সিনার মধ্যে রক্ষিত ছিলো। তিনার সামনে কেউ রাসূল (সাঃ)'র পবিত্র নাম মোবারক নিলে তিনার চেহারার রং পাল্টে যেত। হজ্বের ইহরাম বাধার পর তিনি আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) যে কত বড় এলমে তাসাউফের অধিকারী ছিলেন তা তিঁনার জীবনির ছোট্ট একটা কারামত থেকে বুজা যায়ঃ
একবার খলিফা মনসুর ইমাম ছাহেবকে পরিক্ষা জন্য ইবনে মুহাজির কে অর্থ নিয়া মদিনায় পাঠালেন। বললেন, আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান, জাফর ইবনে মুহাম্মদ ও তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে কাছে গিয়ে বলবে আমি আপনাদের অনুসারি, খোরাসান থেকে কিছু অর্থ নিয়ে এসেছি, খোরাসানের লোকজন আপনাদের জন্য এই অর্থ পাঠিয়েছে। এবং খলিফা মনুসর কাকে কি পরিমান অর্থ দিবে তা গোপনে ইবনে মুহাজিরকে লিখে দেয়। কিন্তু অর্থ প্রদানের সময় শর্ত দিবে যে, যেহেতু আমি অন্যদের প্রেরিত সেহেতু আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনার যে যে পরিমান অর্থ গ্রহন করবেন তা দয়া করে কাগজে লিখে দিবেন। ইবনে মুহাজির খলিফা মানসুরের নির্দেশ মত তাই করলেন এবং দায়িত্ব সম্পন্ন করে মদিনা থেকে খলিফার দরবারে গেলেন। খলিফা মানসুর ইবনে মুহাজিরের কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলে ইবনে মুহাজির বলেন, " জাফর ইবনে মুহাম্মদ অর্থ গ্রহন করেন নি। যখন আমি তাঁর কাছে যাই তখন তিনি মসজিদুন্নবীতে নামাজ পড়ছিলেন। আমি তাঁর পিছনে গিয়ে বসলাম। মনে মনে ভাবলাম, যখন তিনি নামাজ শেষ করবেন তখন আমার কথা তাকে বলবো। কিন্তু তিনি নামাজ শেষ করা মাত্রই আমার দিকে ঘুরে বললেন, হে লোক! আল্লাহকে ভয় করো, মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর আহলে বায়াতের সাথে প্রতারনার চেষ্টা করো না। "
মানুসর ইবনে মুহাজিরের নিকট এ বর্ননা শুনে বললো, " নিঃসন্দেহে তিনি (হযরত জাফর সাদেক) মুহাদ্দিস ( যার সঙ্গে ফেরেশতারা কথা বলে) যার কাছে ইহলাম আসে।
তিঁনার পবিত্র বানী সমূহঃ
১. "যার মধ্যে পাঁচটি পর্যায় রয়েছে সে সবোর্ত্তম ব্যক্তিঃ ভালো কিছু করে আনন্দ পাওয়া, খারাপ কিছু করলে কষ্ট পাওয়া, আল্লাহর তরফ থেকে কিছু পেয়ে কৃতজ্ঞ হওয়া, আল্লাহর পরীক্ষায় ধৈর্যধারন করা এবং অন্যায় বা ভূল করে ক্ষমা প্রার্থনা করা।"
২. একজন তৃষ্ণাতুর মানুষ ঠান্ডা পানি পেলে যতখানি তৃপ্তিবোধ করে ঠিক তেমনি একজন ঈমানদার অন্য ঈমানদারের সাক্ষাত পেলে তার চাইতেও অধিক স্বস্তি বোধ করে।
৩. হীনতা নীচতা অবলম্বনের ব্যতিত একটা লোকও বিপদগামী হয় না।
৪. ক্রোধ জ্ঞানী লোকের আত্নার পরিপূর্ন ধবংসকারি। যে তার রাগকে দমন করতে অক্ষম, সে তার মনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না।
৫. সন্দেহ পোষন না করা, একজন ঈমানদারের প্রতি অন্য ঈমানদারের অধিকার সমূহের অর্ন্তভূক্ত।
৬. আল্লাহর জিকিরের অর্থ হলো তাঁকে স্মরন করতে গিয়ে অন্য যে কোনো বস্তুকে ভূলে যাওয়া।
৭. জ্ঞানি সে ব্যক্তি যিনি দুটো ভালো কাজের মধ্যে বেশি ভালটা আর দুটো খারাপ কাজের মধ্যে কম খারাপটা গ্রহন করে।
৮. মানুষের সুখের একটা দিক হলো তার অমায়িক ব্যবহার।
এই মহান তাপস ১১৪-১৪৮ হিজরি পযর্ন্ত মুসলিম উম্মাহর হেদায়েতের দায়িত্ব পালন করেন। ৩৪ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়ার পর আব্বাসিয় শাসক মানসুর দাওয়ানিকির বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ১৪৮ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল শাহাদাত বরন করেন।
তিনি সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তমী (রহঃ) কে এলমে তাসাউফের জ্ঞান দান করেন এবং আধ্যাত্নিক উত্তারিকারি করে যান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন