| | বঙ্গাব্দ

হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ)

 হযরত নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ)

হযরত নূর মুহমাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ)

ভারত বর্ষে তরিকার ইমাম হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানি (রাঃ) ছাহেব যে সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন সে অব্যাহত ধারায় বাংলা ভাষা-ভাষিদের নিকট নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকার আদি পিতা হিসাবে যিনি পরিচিত তিঁনিই হচ্ছেন আমাদের নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকা ৩১ তম মুর্শেদ সূফী নুর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) ছাহেব। তিঁনি "গাজীয়ে বালাকোট" নামে অধীক পরিচিত। 


১৭৭৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার নিজামপুর পরগনার মিরসরাই থানার মিঠানালা গ্রামে সুফি হযরত মুহাম্মদ ফানাহ্ (রহঃ) ছাহেবের ঔরষে জন্মগ্রহন করেন তিঁনি।


বিদুষী মাতার নিকট তিঁনার শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের জন্য তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট কুজুর্গ নোয়াখালির হযরত মাওলানা শেখ জায়েদ (রহঃ) সাহেবের নিকট গমন করেন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। 


১৭৯১ সালের দিকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহনের জন্য  কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। "চল্লিশ আওলিয়ার কাহিনী" নামক পুস্তকের ৫২০ পৃষ্ঠায় লেখক তিঁনার সম্পর্কে বলেন," বাল্যকাল থেকে তিনি নম্র ও ভদ্র স্বভাবের ছিলেন। নামাজ, রোজা, নফল ইবাদতের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষন ও অনুরাগ ছিলো। ছাত্র জীবনে তিঁনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ, এশরাক ও চাশত এর নামাজ আদায় করতেন।"


শিক্ষা জীবন শেষ করে তিঁনি সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন।


১৮০০ সালে তিঁনি এক তাৎপর্যময় স্বপ্ন দেখলেন। তিঁনি স্বপ্নে দেখেন হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) বলতেছেন, 

"আমার আওলাদ সৈয়দ আহম্মদ কলিকাতা এসেছে, তুমি তার নিকট বাইয়াত গ্রহন করে শিক্ষা লাভ কর।" স্বপ্নে হুকুম প্রাপ্ত হয়ে কালবিলম্ব না করে তিঁনি সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভী (রহঃ) ছাহেবের নিকট গমন করে মুরিদ হন এবং তিঁনার কদমে একনিষ্ঠ সাধনায় মগ্ন হয়।


আপন পীরের খেদমতে চলতে থাকে কঠিন রেয়াযত। সূর্যের আলোয় তিনি শিক্ষকতা, তরবারি চালনা প্রশিক্ষন, ঘোড়া দৌড়ের কসরত, হেদায়েত আর জেহাদের প্রস্তুতির জন্য বক্তৃতা, মুজাহিদ বাহিনীতে লোক ভর্তি করা আর রাতের আধাঁরে তসবিহ, তাহলিল ও সিজদায় কাটাতেন। অল্প আহার, অল্প নিদ্রা, অল্প কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলেন আপন পীরের কদমে থেকে।  ঠিক ঐ সময়টা ছিলো ইংরেজ শাসন আমল। ইংরেজদের টার্গেট ছিলো মুসলামনদেরকে অশিক্ষিত, কর্মহীন করে রাখা। ভারতবর্ষে বিধর্মী শাসক থাকার কারনে মুসলমানগণ স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করতে পারছিলো না। স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে দিয়ে প্রচার করে যে, " পরাধীন রাষ্ট্রের হজ্ব করার প্রয়োজন নেই। যাতায়ত পথ নিরাপদ নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হজ্ব করা জায়েজ নেই। তখন আপন পীরের হুকুমে সূফী নিজামপুরী (রহঃ) ছাহেব "হজ্জ পালন" আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলেন। শত শত মানুষ নিয়ে আপন পীরের সাথে হজ্ব যান।  তিঁনার কারনে ই আজ ভারতবর্ষের মুসলমারগণের হজ্ব করার রাস্তা উন্মুক্ত।


"শিখরা তরবারী ও কুরআন উঠিয়ে দিয়েছে,

সারা দেশে মুসলমান মৃত্যুবরন করেছে।" শিখরা বিভিন্ন স্থানে জবর দখল কায়েম করলো। মুসলমানদের উপর অত্যাচারের সীমা অতিক্রম করলো। হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করলো। মসজিদে আযান নিষিদ্ধ করলো। গরু জবেহ নিষিদ্ধ করলো।  আপন পীর সৈয়দ আহম্মদ (রহঃ) ছাহেব শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য ১৮২৬ সালে ১৭ জানুয়ারী থেকে প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোট প্রান্তরে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। হযরত সূফী নিজামপুরী (রহঃ) ছাহেব প্রথম থেকেই আপন পীরের সাথে ছিলেন। দুর্গম পথে আপন পীরের হুকুম মাথায় নিয়ে  ৩০০০ মাইল রাস্তা পাড়ি দেন।  সর্বশেষ বালাকোট প্রান্তরে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। গাজীর বেশে তিঁনি রনাঙ্গন থেকে ফিরত আসেন। যার জন্য তিঁনাকে " গাজীয়ে বালাকোট" খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও বিধর্মীদের সাথে আপন পীরের হুকুমে আকুড়ার যুদ্ধ, হাজ্রুতের হামলা, শায়দূর যুদ্ধ, পাঞ্জতার যুদ্ধ, মায়দার যুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।


মুসলামানগণের সেই জিহাদি অগ্নিশিখায় মুসলমানগণ তাদের অধীকার ফিরে পায়। বালাকোট প্রান্তর থেকে তিঁনি কলকাতায় ফিরত আসেন। বেশ কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করেন। 

সেই সময় মুসলামানগণের মধ্যে চালু হওয়া হিন্দুরীতি যেমন সালামের পরিবর্তে আদাব বা নমস্কার, কপালে তিলক, মুসলমান মহিলারা শাঁখাসিঁদুর ব্যবহার, তুলসী গাছ রোপন, ধূতি পড়া, মেয়েদের লক্ষী বলে ডাকা ইত্যাদি এসব বিদায়াত থেকে মুসলমানগণকে তিঁনি রক্ষা করেন।

১৮৪০ সালে তিঁনি চট্টগ্রামে তাসরীফ নেন। চট্টগ্রামের মিঠানালায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিঁনার নূরের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে হাজার হাজার মানুষ তিঁনার সোহবতে আসতে শুরু করেন।  তিঁনি মানুষের মধ্যে হযরত রাসূল (সাঃ) এঁর প্রেম জাগ্রত করেন। তিঁনার দোয়ার বরকতে হযরত শাহসূফী ফতেহ আলী (রহঃ) ছাহেব "রাসূল নোমা" উপাধীতে লাভ করেন। 


সূফী সাধক শিরোনামে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে দেখা যায়, সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) ছাহেব চট্টগ্রাম আসার পর থেকে তিঁনার কারামত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফটিকছড়ি উপজেলার হযরত নুর মোহাম্মদ নিজামপুরী ছাহেবের মুরিদ তিঁনার জন্য নিজের গাভীর দুধ নিয়ে আসছিলেন। তখনকার সময় গভীর জঙ্গল, ঝোপঝাড় ছিল, কান পাতলে শেয়ালের ডাক শুনা যেত। আছরের ওয়াক্ত সমাগত প্রায়। মিঠানালায় দরবার শরীফে হযরত নূর মোহাম্মদ নিজামপূরী (রহঃ) ছাহেব ওযুর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খাদেম সাহেব ওযুর পানি বদনা দিয়ে ঢেলে দিচ্ছেন। হঠাৎ সূফী সাহেব জালালী হয়ে গেলেন। খাদেম সাহেব থেকে বদনাটা টান দিয়ে ছুঁড়ে মারলেন পুকুরের দিকে, খুব জোরে আওয়াজ করে বললেন," দূর হও"। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে নিশ্চুপ দাড়িঁয়ে রইলো। মাগরিবের খানিক আগে ঐ মুরিদ দরবারে পৌছালেন। দুধ সাথে সূফী ছাহেবেন ছুঁড়ে মারা বদনা। সবাই অবাক।  তখন মুরিদ বললেন, " পথিমধ্যে বাঘ আমাকে আক্রামন করতে উদ্যত হয়, তখন আমি হুজুরকেবলার নাম দিয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি। ঠিক তখনই একটি বদনা এসে বাঘের গায়ে এসে সজোরে আঘাত করে। বাঘ ছটপট করতে করতে বদনা ফেলে চলে যায়। আমি নিজে কানে হুজুরপাকের পবিত্র কন্ঠ মোবারকে শুনি 'দূর হও।


তিঁনি ফরমাইতেন, " জাকেরগণের রুজির জন্য ভয় নাই।"


১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর তিঁনি ওফাত লাভ করেন। তিঁনি ওফাত লাভের পূর্বে পবিত্র নেয়ামতের ঢালা "শাহ সূফী হযরত ফতেহ আলী (রহঃ) ছাহেবের মস্তকে অর্পন করে যান।

নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকার সেই ধারা বর্তমানে বিশ্ব জাকেরর মঞ্জিল বহমান।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন