| | বঙ্গাব্দ

মোহাছাবা

 মোহাছাবা

মোহাছাবা

শরীয়তের পাঁচ রোকন যথাঃ কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত ঠিক তেমনি তরিকতের ও পাঁচ রোকন যথাঃ জিকির, রাবেতা, মোরাকাবা, মোহাছাবা ও শোগল। তরিকতের এই পাঁচ রোকনের অন্যতম ও গুরত্বপূর্ন  রোকন হলো "মোহাছাবা"।


মোহাছাবার আভিধানিক অর্থ হিসাব গ্রহন।

তরিকতের পরিভাষায় মোহাছাবা হইল, দিন শেষে রাত্রিতে নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে কিছুক্ষন সারা দিনের কৃতকর্মের পুংখানুপুংখ হিসাব গ্রহন করা।

শয়নকালে হিসাব গ্রহন করলে লাভ-ক্ষতির আন্দায পাওয়া যায়। শরীয়তে যে সকল কাজ অবশ্যকর্তব্য বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে, উহা যথাযথ পালন করিলে মূলধন ঠিক থাকে। ঐ কাজ সমূহ পালন করে অতিরিক্ত কাজ যেমন, ফাতেহা শরীফ, খতম শরীফ, রহমত পালন, সৎকাজ, সদকা, ভালো ব্যবহার ইত্যাদি করিলে এইগুলো লাভে পরিগনিত হয়। 


মানুষ দুনিয়ার স্বার্থের জন্য অংশীদার থেকে তার পাওনা কড়াকড়ি ভাবে হিসাব করে নেয় ঠিক তেমনি আখেরাতের জন্যও নিজের প্রবৃত্তির হিসাব কড়াকড়ি  ভাবেই করতে হবে। 

তাই হযরত পীর কেবলাজান ফরমান, " সারা দিনে সম্পাদিত সমস্ত কাজ যদি খোদাতায়ালার আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী পরিচালিত হয়, তবে আল্লাহর শোকরিয়া  আদায় করা। আর যদি ভূল-ভ্রান্তি হয়,তবে অনুতপ্ত হইয়া খোদাতায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা।"


শেষ বিচার দিনে মহান খোদাতায়ালা নিজে হিসাব গ্রহন করিবেন। 

আল্লাহপাক কোরআন মাজিদে ফরমান, " ন্যায় বিচারের দাঁড়ীপাল্লা আমি কিয়ামতের দিন স্থাপন করিব, তখন কাহারও প্রতি কোন রূপ অবিচার করা হইবে না" - সূরা- আম্বিয়া।  অর্থাৎ সে দিন রেনু বা সুক্ষ্ম  পরিমান বিচার হইবে।

" প্রত্যেকটি মানুষ পৃথিবীতে পুংখানুপুংখ রুপে হিসাব করিয়া দেখুক-আগামী কাল্যের (অর্থাৎ কিয়ামতের মহা বিচার দিবসের) জন্য কি প্রেরন করিয়াছে।"

সূরাঃ হাশর। 

এখানে মহান খোদাতায়ালা স্বংয় হিসাব নেয়ার পূর্বে বান্দাকে হিসাব তথা মোহাছাবার কথা বলেছেন।


হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) ফরমান, 

" যে ব্যক্তি সদা সর্বদা নিজের কৃতকর্মের হিসাব রাখিতে থাকে এবং মৃত্যু পরে কাজে লাগিবে এমন কার্য করিয়া থাকে -সেই বুদ্ধিমান।


হিসাব গ্রহন বা মোহাছাবা সম্পর্কে হযরত উমর (রাঃ) ফরমান, " কিয়ামত-দিবসে তোমাদের হিসাব নিকাশ গ্রহন করিবার পূর্বে তোমরা নিজের হিসাব নিকাশ গ্রহন কর।"  

তিঁনি প্রতি রাতে বাড়ি ফিরে নিজের পা'য়ের মধ্যে দোররা মারিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন, " তুই অদ্য কি করিয়াছিস?" তিঁনি প্রতি দিন মোহাছাবা বা নিজের হিসাব নিতেন।


মানুষ তার আখেরাতের হিসাবের বেলায় একদম উদাসিন। মানুষ যে পরিমান পাপ করে তা যদি এক একটি কঙ্কর হিসাবে রাখা হয় তাহলে একটি ঘর পরিপূর্ন হয়ে যাবে। 


হযরত ইবনে সাম্মান (রহঃ) নামক এক বুযুর্গ হিসাব করিয়া দেখিলেন যে, তাহার বয়স ৬০ বছর হইয়াছে। উনি হিসাব করে দেখলেন ৬০ বছরে ২১৬০০ দিন। তারপর নিজে নিজে বলিতে লাগলেন হায় আফসোস!! আমি যদি প্রতি দিন একটি করিয়াও পাপ করে থাকি তাহলে ২১৬০০ টি পাপ করেছি আর যদি ২ টি করে পাপ করি তাহলে ৪৩২০০ টি পাপ করিয়াছি। 

হায়!! এমতাবস্থায় পরিত্রান কিরুপে হইবে? এমন চিন্তা করিয়া বিকট চিৎকার পূর্বক ইহলোক ত্যাগ করেন।


অথচ আমরা প্রতিদিন কত হাজার পাপ করি আমাদের হিসাব নেই। আমাদের পাপের হিসাব লিখার কারনে যদি " কেরামিন-কাতেবিন" ফেরশতাদেরকে মজুরী দেয়া লাগতো তবে আমাদের সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাইতো।

আমরা ১০০ বার সুবহান্নাল্লাহ বা আল্লাহু আকবার তসবীতে হিসাব করে পড়ি। কিন্তু দিবা-রাত্রি বেহুদা কথা বলি তার কোন হিসাব ই লই না। যদি হিসাব রাখিতাম তাহলে সহস্রাধিক বেহুদা কথা হতো প্রতিদিন।


হযরত রাসূল (সাঃ) ফরমান, 

" ইহ জগতের একটি দিন ও রাত্রি ২৪ ঘন্টার"। 

হযরত পীর কেবলাজান এই হাদিস খানার ব্যাখায় ফরমান, বিচার দিবসে ২৪ ঘন্টার বিনিময়ে ২৪ টি ভান্ডার মানুষের সামনে স্থাপন করা হইবে এবং প্রত্যেকটি ভান্ডারের দরজা খুলিয়া মানুষকে দেখান হবে।

যে ঘন্টায় নেককাজ হইয়াছে সে ভান্ডার খোলা মাত্র সুগন্ধি সুবাস আর জ্যোতিবের হবে। সকলে আনন্দিত হইবে। 

অতঃপর আর একটি দরজা খোলা হইবে সেই ভান্ডার থেকে বিকট দুর্গন্ধ ও ঘোর কৃষ্ঞ বর্ন দেখা যাবে। কারন ঐ ঘন্টায় বান্দা পাপ কাজে লিপ্ত ছিলো। 

আর একটি ভান্ডারের দরজা খোললে দেখা যাবে একবারে শূন্য। কারন ঐ সময় বান্দা পাপও করে নি পূন্যও করেনি। বেহুদা সময় কাটাইছে। মানুষ এ শুন্য ভান্ডার দেখে আফছোচ করবে আর অনুতপ্ত হবে।


হযরত আয়েশা (রাঃ) ফরমান,

 " ইন্তেকালের সময় হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন, উমর (রাঃ) অপেক্ষা অধিক প্রিয় আমার বন্ধু নাই। তৎক্ষনাৎ তিঁনি বলিলেন, হে আয়েশা, আমি কি বলিলাম? হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আপনি বলিয়াছেন, উমর অপেক্ষা অধিক প্রিয় আমার বন্ধু নাই।

 তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁহার উক্তি সংশোধন করিয়া বলিলেন, তাহা নহে, উমর অপেক্ষা অধিক প্রিয় অামার কেউ নাই।" 

হযরত আবু বকর (রাঃ) এতকুটু কথার হিসাব নিয়ে দেখলেন ঠিক হয় নি তিঁনি সাথে সাথে কথা সংশোধন করিয়া লইলেন। 

আর আমি??? 

তাই পীর কেবলাজান ফরমান, " খোদা প্রাপ্তির পথে অল্প আহার ও অল্প নিদ্রার সাথে সাথে অল্প কথার অভ্যাস করিতে হয়।"


হযরত হাসান (রাঃ) বলেন, 

" যে মন নিজকে তিরস্কার করে এবং কার্য শেষে সর্বদা এইরূপ হিসাব লয় যে, তুমি অমুক কাজ কেন করিলে, অমুক বস্তু কেন আহার করিলে? এমন মনকেই '' নফসে লাওয়ামা" বলে।


বুদ্ধিমান লোক সময়কে চার অংশে ভাগ করেঃ

১. স্বীয় কাজের হিসাব-নিকাশ গ্রহন করে

২. আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে।

৩. জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করে

৪. দুনিয়ার হালাল দ্রব্য উপভোগে নিদোর্ষ অারাম লাভ করে।


মহান খোদাতায়ালার কাছ থেকে মানুষ ''আমানত" হিসাবে পঞ্চ ইন্দ্রিয়,  সৃজনশীলতা, জ্ঞান-বিবেক, ইচ্চা শক্তি ধার এনেছে।

 সেই ইন্দ্রিয়গুলোর প্রতিদিনের হিসাব করাই মোহাছাবা।  

হাত দেয়া হয়েছিলো পবিত্র ও হালাল বস্তু ধরার জন্য কিন্তু আমি হাত দিয়ে কি ধরলাম? 

জ্বিহবা বা বাকি ইন্দ্রিয় গুলো যে কারনে আল্লাহ আমাকে দান করছেন আমি কি সে গুলো ঠিকমত ব্যবহার করছি কিনা দিন শেষে তার হিসাব গ্রহন করা।  হিসাবে গরমিল হলে কতবড় ক্ষতি হয় তার একটা উদাহরন দেয়া যাক, 

হযরত পীর কেবলাজানের পবিত্র নসিহত শরীফের ২য় খন্ড হতে হুবহু তুলে ধরলাম,

 " বিসাই মুনসী নামক তোমাদের এক জাকের ভাই ছিলো। সে দীর্ঘদিন আল্লাহ রাসূলের দরবার, এই বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে খেদমত করিয়াছিল। 

ফলে তাহার বাক্য সিদ্ধ হইয়াছিল। সে যাহা বলিত, তাহা সত্য হইত। বাক্য সিদ্ধ হওয়ার পর সে খেদমত বন্ধ করিয়া নিজেই বাড়িতে জলসা করা শুরু করিল। আমি তাহাকে একদিন ডাকিয়া বলিলাম, বিসাই মুন্সী! ব্যাটারীতে চার্জ দিলে কিন্তু ২৪ ঘন্টার বেশী থাকে না। তুমি আর কিছুদিন খেদমত করিয়া স্থায়ী চার্জের অধিকারী হও।  

কিন্তু বিসাই মুন্সী আমার কথা শুনিল না। সে মোহাছাবায় ভুল করিল। কিছুদিন পর তাহার কথার ফয়েজ নষ্ট হইল। ঝড়ে ঘর-বাড়ী ফেলাইয়া দিল। ব্যবসা করিতে যাইয়া সঞ্চিত টাকা নষ্ট করিয়া ফেলিল। তৎপর সে মারা গেল। সে যদি একটু মোহাছাবা করিয়া দেখিত যে, পীরের সান্নিধ্যে থাকিয়া চার্জ স্থায়ী করিয়া নেওয়াই উত্তম, তাহা হইলে তাহার এমন ভয়াল পরিনতি হইত না।'

কাজেই তোমরা তোমাদের প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি কথা, প্রতিটি পদক্ষেপকে মোহাছাবায় মাধ্যমে যাচাই করিয়া দেখ। পীর যখন যে ইশারা দেন, সেই ইশারামত চল। আমার পীর কেবলাজান বলিয়াছেন, " পীরের ইশারা যে বুঝে না, দ্বীন-দুনিয়া উভয়ই সে খোলা দিয়া খায়।"


তাই হিসাব করে দেখুন মহান খোদাতায়ালার আমানত, হযরত পীর কেবলাজানের হুকুম আমার কতটুকু পালন করতে পেরেছি। 


আল্লাহপাক তিঁনার প্রিয় বন্ধু আমার হযরত পীর কেবলাজানের খাতিরে মহা দয়াবান হিসাব লইবার পূর্বে ই যেন আমরা নিজেদের হিসাব নিজেরা করে তিঁনার কদমে দাঁড়ানোর তৌফিক দান করেন। 

আমিন!!!

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন