| | বঙ্গাব্দ

তরিকায় নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়ার শ্রেষ্ঠত্ব

 

তরিকা খোদাপ্রাপ্তির পথ।
তরিকা যামানার ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে মুক্তির পথ।
তরিকায় নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়ার শ্রেষ্ঠত্ব

তরিকা আরবি শব্দ। যার বহু বচন তারাইক যার অর্থ সিরাত, মাজহাব, অবস্থা। এছাড়াও তরিকার বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যেমনঃ পদ্ধতি, রীতি, উপায়, রাস্তা, মাধ্যম, স্তর ইত্যাদি।
তরিকার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আত্নার বিজ্ঞানীরা বলেন, " আল্লাহর পথের অনুসারীদের বিভিন্ন মানজিল অতিক্রম করে উঁচু স্তরে উন্নতি হওয়ার জন্য যে বিশেষ রীতি-পদ্ধতি তাই হলো তরিকা।
উইকিপিডিয়াতে বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত ২৫টির মত তরিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামী বিশ্ব কোষ ১ম খন্ডে বিভন্ন তরিকা ও তার শাখা-প্রশাখার একটি তালিকা তৈরা করা হয়েছে যেখানে প্রায় ১৮০ টি তরিকার নাম উল্লেখ আছে। তবে এসকল তরিকার মধ্যে চার (৪) টি তরিকা সারা পৃথীবিতে খুবই প্রসিদ্ধ। যথাঃ কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নক্সবন্দীয়া ও মুজাদ্দেদীয়া।
আমার পীর কেবলাজান হুজুর যামানার জিন্দাওলী বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের প্রতিষ্ঠিত দরবার বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে তরিকায় নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া প্রচার করা হয়। এই নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়া আলোচনার করার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
নক্সবন্দীয়া তরিকার প্রবর্তক হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহঃ)। 'নকশবন্দ শব্দের অর্থ নকশাকার। যে সকল তালেবে মাওলা রূহানি তালিম লাভের জন্য তাঁহার নিকট হাজির হইতেন, তাঁহার তাওয়াজ্জোহ ওই সকল সালেকের অন্তরে এমন ভাবে নকশা অংকন করিত যে, তাঁহারা অতি সহজেই তাঁহাদের মকসুদ মঞ্জিলে পৌঁছিয়া যাইতেন যার কারনে তিঁনি নকশবন্দ নামে পরিচিত ছিলেন।
তিঁনার পীরের কদমে সুর্দীঘ সময় খেদমতের পর আপন পীর তিঁনাকে খেলাফত দান করেন এবং মানুষ কে হেদায়াতের জন্য পবিত্র হুকুম দান করেন। আপন পীরের পবিত্র হুকুম মাথায় নিয়ে তিঁনি হেদায়েতের জন্য নিজ দেশে আসলেন।
তিঁনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারন আল্লাহপাকের দীদার লাভ বা সান্নিধ্য অজর্নের শর্ত অনেক কঠিন।
খোদাতায়ালার সান্নিধ্য অর্জনের জন্য হযরত খাজা বায়েজিদ বোস্তামি (রহঃ) কে চল্লিশ (৪০) বছর, হযরত গাউস পাক (রহঃ) ছাহেবকে পয়তাল্লিশ (৪৫) বছর, তিঁনার পীর হযরত আমীর কুলাল (রহঃ) ছাহেবকে দীর্ঘ পয়ত্রিশ (৩৫) এবং হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ) ছাহেব নিজে ৫০ বছর বহু ত্যাগ তিতিক্ষা করিয়া খোদাতায়ালার সান্নিধ্য অর্জন করিয়াছেন যা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য বড়ই কষ্ট কর। তখন তিঁনি মনস্থ করিলেন, খোদাতায়ালার নিকট উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য একটি সহজ ও আসান তরিকা প্রার্থনা করিবো। তিঁনি সেজদায় লুটাইয়া পড়িলেন। সেজদার মধ্যেই তিঁনি বলিলেন, " এলাহী! তোমার রহমতের আশায় তোমার দরবারে এই ভিখারী মস্তক স্থাপিত হইয়াছে। এই সেজদার মধ্যে যদি ইন্তেকাল হইয়া যায়, তবে আমি আমার খুন মাফ করিয়া দিলাম। তবুও আসান তরিকা না লইয়া আমি মাথা তুলবো না।" আল্লাহপাকেন পক্ষ থেকে এলহাম হইল, " আমি যেরূপ চাই তুমি সেইরূপ সিলসিলা গ্রহন করো।"
তিঁনি বার বার জবাব দিলেন, " ইয়া আল্লাহ! তোমার বান্দা বাহাউদ্দিন যেমন আসান তরিকা চায় সেই রূপ তাঁহাকে দান কর"। দিনের পর দিন যায় রাতের পর রাত কিন্তু খাজা ছাহেব সেজদা থেকে মস্তক উঠান না। হায়! উম্মতে মুহাম্মদির কি হবে!! এই চিন্তার অনবরত ক্রন্দন করতে থাকলেন। এই ভাবে পনের (১৫) দিন গত হইল।
দয়াময় খোদাতায়ালার এলহাম হইল, " আমি তোমার দোয়া কবুল করিলাম। তোমাকে এমন এক তরিকা দান করিলাম, যে তরিকায় কেহ দাখিল হইলে যে মাহরূম থাকিবে না।"
হযরত সেজদা হইতে মস্তক তুলিলেন। প্রান ভরিয়া তিঁনি শোকরানা আদায় করিলেন। এবং বলিলেন, " আমি হক সোবহানাহু তায়ালার নিকট হইতে এমন তরিকা চাহিয়া লইয়াছি, যে তরিকায় আল্লাহপাকের সহিত মিলন অর্নিবার্য।"
তিঁনি আরো বলিলেন, " আমার তরিকা অটুঁট বাধনে বাঁধা। রাসূল (সাঃ) এঁর সুন্নাতের অনুসরন এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনার্দশ আমার তরিকার ভিত্তি।"
তিঁনি বলিতেন, " আমি অন্য তরিকার শেষ বস্তুকে আমার তরিকার প্রারম্ভে প্রবেশ করাই। হকের মারেফাত বাহাউদ্দিন জন্য হারাম যদি আমার প্রারম্ভ হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহঃ) ছাহেবের শেষ অবস্থার মত না হয়"।
অর্থাৎ সকল তরিকা যেখানে শেষ এই তরিকা সেখান থেকে শুরু। সকল তরিকা নফসে প্রথম সবক দান করেন আর একমাত্র এই তরিকায় ই লতিফায়ে কাল্বে প্রথম সবক দেয়া হয়।
মুজাদেদ্দীয়া তরিকার প্রবর্তক হযরত মুজাদ্দেদ আল ফেসানী (রাঃ) ছাহেব। সাহাবায়ে কেরামের যুগের পর থেকে তিঁনার মত এত উচ্চমানের বুযর্গ দুনিয়াতে আগমন করে নাই। কেবলাজান হুজুর পাক ফরমান, " দুনিয়াতে দুই জন মানুষের পীর স্বংয়ং আল্লাহ তায়ালা, একজন হযরত রাসূল (সাঃ) অন্য জন হযরত মুজাদ্দেদ ছাহেব"।
হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহঃ) কাশফ যোগে দেখিতে পান " আসমান হইতে একটি নূর প্রকাশ পাইয়া সারা বিশ্ব আলোকিত করিল। এই সময় এলহাম হলো, " আজ থেকে পাঁচশত বছর পরে যখন পৃথিবী শেরেক ও বেদাতের ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইবে, তখন উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে এক অসাধারন ব্যক্তি জন্মগ্রহন করিবেন তিনি শেরেক বিদাতের মূল উচ্ছেদ করিবেন"। আর সেই মহান পুরুষ হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (রাঃ) ছাহেব। শৈশবে তিনি চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মাসায়েখ হযরত শাহ কামাল কায়থেলীর (রহঃ) ছাহেবর নিকট হইতে চিশতিয়া তরিকার নেয়ামত প্রাপ্ত হন। তিঁনার পিতা হযরত আব্দুল আহাদ (রহঃ) ছাহেব কাদেরিয়া চিশতিয়া ও সাবেরিয়া তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত ছিলেন। পিতার নিকট হইতে তিনি কাদেরিয়া, চিশতিয়া ও সাবেরিয়া তরিকার নেয়ামত প্রাপ্ত হন।
কিন্তু তিঁনার পিতা মাঝে মাঝেই বলতেন, " খোদাপ্রাপ্তির দুর্গম পথ ও দায়েরা কেন্দ্র কেউ যদি পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহা নকশবন্দীয়া তরিকার ওলীরাই প্রাপ্ত হইয়াছেন। কাশফের দৃষ্টিতে এই তরিকাটি কেন্দ্র এবং রাজপথের মত মনে হয়। " তিঁনার পিতার হুকুমে তিঁনি নক্সবন্দীয়া তরিকার নেছবত হাসিলের জন্য ঐ তরিকার অনেক বুজুর্গের নিকট গমন করেন। সর্বশেষে হযরত খাজা বাকি বিল্লাহ (রহঃ) ছাহেবের নিকট বায়ত গ্রহন করিয়া এই তরিকার নেছবত হাসিল করেন।
মাকতুবাত শরীফের ১ম খন্ডের ২৯০ নম্বর পৃষ্টায় তিঁনি বলেন, "জানা প্রয়োজন যে, আল্লাহতায়ালার মারেফতের জ্ঞান হাছিলের জন্য যে পথ নিকটতর, মজবুত, অতীব সত্য, শান্তিপূর্ন সেই পথ ই হলো তরিকায়ে নক্সবন্দীয়া। ''
তিঁনি আরো বলেন, নক্সবন্দীয়া তরিকার বুযুর্গানে দ্বীনের কথা ঔষধের ন্যায় এবং দৃষ্টি রোগ মুক্তির কারন স্বরূপ। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁহাদের সহিত ছোহবতের কারনে বহু বছরের কাজ মূহুর্তের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে।"
তিঁনি এক দিকে ছিলেন হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) হইতে খিরকার মাধ্যমে নেয়ামত প্রাপ্ত, আবার হযরত কামেল কায়েথালীর মাধ্যমে চিশতিয়া তরিকা সহ তিনি পৃথক পৃথক ভাবে সবগুলি তরিকার তথা নেছবত ও কামালিয়াত প্রাপ্ত হন।
একদা হযরত মুজাদ্দেদ (রাঃ) ছাহেব মুরিদান সহ ফজরের নামাজের পর মোরাকাবায় রত। এমন সময় তিনি দেখিলেন, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) সহ কাদেরিয়া তরিকার অন্যান্য মাশায়েখ গন হুজরা উপস্থিত হলো। কিছু পর দেখলেন, তিঁনার হুজরায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) সহ নক্সবন্দীয়া তরিকার সকল মাসায়েখ গন উপস্থিত হলো। হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নক্সবন্দ (রহঃ) হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহঃ) ছাহেবের নিকটে গিয়ে হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহঃ) ছাহেবের উদ্দেশ্য বলিতে লাগিলেন, " শেখ আহমদ সেরহিন্দী (রাঃ) আমাদের প্রতিপালনের দ্বারা কামালিয়াত হাছিল করিয়াছেন, আপনি অনর্থক তাঁহাকে আপনার দলভূক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এই কথার জবাবে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ছাহেব বলিলেন, " শায়খ আহমদ (রাঃ) প্রথমেই আমাদের তরিকা হইতে ফয়েজ প্রাপ্ত হইয়াছেন। কাজেই সে আমাদের দল ভূক্ত।" এই সময় তরিকার মাসায়েখগন তিঁনার হুজরায় তাসরিফ আনেন এবং তিঁনাকে আপন আপন তরিকা ভুক্ত বলিয়া দাবি করেন। ঐ সময় উম্মতে মুহাম্মদির সকল আউলিয়াগন সেরহিন্দ শরীফে সমবেত হন। এই সময় ছিলো ১০১১ হিজরির ১১ ই শাবান সকাল হইতে জোহরের নামাজের শেষ পর্যন্ত।
অতঃপর আল্লার রাসূল (সাঃ) আউলিয়াগনের এই বিশাল সমাবেশে তাসরিফ আনেন। তিঁনার খেদমতে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। রাসূল (সাঃ) বিষয়টির মিমাংসা করেন। তিঁনি সমস্ত তরিকার মাসায়েখগনকে সান্তনা দিয়ে বলেন, যেহেতু শায়খ আহম্মদ সেরহিন্দী (রাঃ) এঁর পরিপূর্নতা বা কামালিয়াত নক্সবন্দীয়া তরিকার উপরে সম্পন্ন হইয়াছে, কাজেই এই তরিকাকেই রেওয়াজ বা প্রচলন দান করা হউক এবং বাকি অন্যান্য সমুদয় তরিকার নেছবতও তাঁহাকে প্রদান করা হউক, যাহার ফলে শেখ আহমদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দেদীয়া তরিকা সমস্ত তরিকার সারাংশ হিসাবে পরিগনিত হইবে এবং তোমরাও সকলে সমভাবে ছওয়াবের অধীকারি হইবে।" হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানি (রাঃ) ছাহেব সমস্ত তরিকার সমন্বয়ে এবং নক্সবন্দীয়া তরিকাকে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করিয়া এমনই এক শ্রেষ্ট তরিকা প্রর্বতন করেন, যাহা সর্ব কালের সর্বশ্রেষ্ঠ তরিকা, " তরিকায়ে নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া।
দাদাপীর খাজা এনায়েতপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেব বলতেন, " যাহারা বেহেশতের মাটি দিয়া তৈরি তাহারাই এই তরিকার ছায়াতলে আসিবে, কারন বেহেশতের মাটি বেহশতেই যাবে।"
আমার পীর কেবলাজান বিশ্বওলী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেব বলেন, " দুনিয়াতে থাকাবস্থায় তোমরা খোদাপ্রাপ্তির পথে যে যতটুকুই অগ্রসর হও না কেন, তোমাদের ছায়ের-ছুলুক যদি জীবৎকালে সম্পন্ন নাও হয়, তবু ভয় নাই। মৃত্যুর পরে কবরের মধ্যে দুই পূণ্যাত্না (রাসূল সা. এবং আপন পীর) তোমাদিগকে প্রশিক্ষন দিবেন, মারেফাতের তালিম দিবেন, ফলে হাশরের মাঠে সকলেই আল্লাহর ওলী হয়ে উঠবে।"
আল্লাহতায়ালার খাস রহমত এই নক্সবন্দীয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকা।
বর্তমান পৃথিবীতে এই তরিকার ধারক ও বাহক বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পবিত্র দরবার শরীফ। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের মহামহিম প্রতিষ্ঠাতা হযরত পীর কেবলাজান হুজুর এই তরিকা বিশ্ব জাকের মঞ্জিল হইতে প্রচার করেন।
আল্লাহপাক এই সত্য তরিকা প্রচারের তৌফিক দান করুন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন